নারীর অধিকার

ভারতের নারীর অধিকার: আইনি মাইলস্টোন এবং প্রগতির ধারা

ভূমিকা

ভারতে নারীর অধিকার অর্জনের পথটি দীর্ঘ এবং জটিল ছিল। ১৯ শতকের আগে, নারীরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতেন, যাদের কোনো আইনগত অধিকার বা সমাজে কোনো অবদান রাখার সুযোগ ছিল না। শিক্ষা, সম্পত্তির মালিকানা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ—সবই ছিল কল্পনার বাইরে। স্বাস্থ্য অধিকার ছিল অপ্রতুল এবং তালাক প্রায় অসম্ভব। তবে, ১৯ শতকের শুরুতে এই অবস্থা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করে, যা ভারতে নারীর অধিকার আন্দোলনের সূচনা করে।

ভারতে নারীর অধিকারের টাইমলাইনের মূল মাইলফলকসমূহ

সতি বিলুপ্তি (১৮২৯):

‘সতি’ (Sati) প্রথা ছিল এক বিধবাকে তার স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা। ১৮২৯ সালে, গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক (Lord William Bentinck) ‘সতি বিলুপ্তি আইন’ (Sati Abolition Act) প্রণয়ন করেন, যা সারা ভারতে এই প্রথাকে নিষিদ্ধ করে। পরবর্তীতে, ১৯৮৭ সালে ‘সতি প্রতিরোধ আইন’  Commission of Sati (Prevention) Act প্রবর্তিত হয়, যা সতি প্রথার উত্সাহ প্রদান বা গৌরবদানের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করে।

কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিয়া বিল (১৯২৫)

১৯২৪ সালে প্রবর্তিত কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিয়া বিল (Commonwealth of India Bill) ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল। এই বিলটি মৌলিক অধিকার, লিঙ্গ সমতা, সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য অধিকার এবং যৌনভিত্তিক বৈষম্য নির্মূলের প্রচার করেছিল।

ডাউনরি নিষিদ্ধ আইন (১৯৬১)

‘ডাউনরি’ (Dowry) প্রথা, যেখানে কনের পরিবার থেকে বরের পরিবারে অর্থ বা সম্পত্তি স্থানান্তর করা হতো, এটি ১৯৬১ সালের ডাউনরি নিষিদ্ধ আইন (Dowry Prohibition Act) দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৬ সালের সংশোধনীর (1986 Amendment) মাধ্যমে আইনটি আরও কঠোর করা হয় এবং IPC এর ধারা ৩০৪বি (Section 304B)(Section 80 of BNS) এবং ভারতীয় প্রমাণ আইন এর ধারা ১১৩বি (Section 113B of the Indian Evidence Act)(Section 118 of BSA) প্রবর্তন করা হয়, যা ডাউনরি-সংক্রান্ত সহিংসতা এবং মৃত্যুর জন্য বিশেষ শাস্তির বিধান করে।

অশ্লীল ট্রাফিক (প্রতিরোধ) আইন (১৯৫৬)

১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত ‘অশ্লীল ট্রাফিক (প্রতিরোধ) আইন’ Immoral Traffic (Prevention) Act মানব পাচার বিরোধী একটি আইন। এই আইন অনুযায়ী, মানব পাচার এবং যৌনকর্মের জন্য নারীদের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ আইনি উন্নয়নসমূহ

বিশাখা গাইডলাইনস (১৯৯৭):

ভানওয়ারী দেবী (Bhanwari Devi) নামের রাজস্থানের এক সমাজকর্মীর গ্যাং রেপের ঘটনার পর, ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ‘বিশাখা গাইডলাইনস’ (Vishakha Guidelines) প্রণয়ন করে। এই গাইডলাইনগুলি কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য নির্দেশনা দেয় এবং অভিযোগ কমিটি প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে, ২০১৩ সালে এই গাইডলাইনগুলি ‘নারীদের কর্মস্থলে যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিকার) আইন’ Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition, and Redressal) Act এর অধীনে কোডিফাই করা হয়।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আইন (২০০৫):

‘নারীদের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স থেকে সুরক্ষা আইন, ২০০৫’ (Protection of Women from Domestic Violence Act, 2005) নারীদের শারীরিক, মানসিক, মৌখিক এবং যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে আদালতের মাধ্যমে সিভিল প্রতিকার এবং সুরক্ষা আদেশ পাওয়া যায়।

মথুরা ধর্ষণ মামলা (১৯৭২):

মথুরা নামের এক কিশোরী, যাকে দুই পুলিশকর্মী হেফাজতে ধর্ষণ করে, এই মামলাটি ব্যাপক জনসাধারণের প্রতিবাদ ও আইন সংস্কারের পথপ্রদর্শক হয়। ১৯৮৩ সালের ‘ফৌজদারি আইন (সংশোধন) আইন’ Criminal Law (Amendment) Act, 1983 এই মামলার পর প্রণীত হয়, যা ধর্ষণ মামলায় সম্মতির অভাব ধরে নেওয়ার বিধান (Section 114A of the Indian Evidence Act) নিয়ে আসে। ২০১৩ সালের সংশোধনী আরও কঠোর শাস্তির বিধান নিয়ে আসে।

নির্ভয়া মামলা (২০১২):

নয়াদিল্লিতে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এক তরুণীর গ্যাং রেপ এবং হত্যাকাণ্ড ভারতজুড়ে প্রতিবাদ সৃষ্টি করে। এর ফলস্বরূপ, ২০১৩ সালে ‘ফৌজদারি আইন (সংশোধন) আইন’ Criminal Law (Amendment) Act, 2013 প্রণীত হয়, যা যৌন অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করে।

আধুনিক আইনি কাঠামো

বৈবাহিক ধর্ষণ (Marital Rape) যদিও ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণ এখনো অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত নয়, ২০১৩ সালের সংশোধনী Criminal Law (Amendment) Act, 2013 সম্মতির বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছরে উন্নীত করেছে। এই আইনটি ‘শিশুদের যৌন অপরাধ প্রতিরোধ আইন, ২০১২’ Protection of Children from Sexual Offences (POCSO) Act, 2012 এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত হয়।

উপসংহার

ভারতে নারীর অধিকার অর্জনের যাত্রা আইনি মাইলফলক এবং অগ্রগতিশীল সংস্কারের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছে। সতি প্রথা বিলুপ্তি থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সহিংসতা ও যৌন হয়রানি সম্পর্কিত আধুনিক আইন পর্যন্ত, এই আইনি কাঠামোগুলি নারীদের অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, এই অগ্রগতির সত্ত্বেও, প্রতিটি ক্ষেত্রেই লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতে এবং চলমান চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবেলা করতে আরো প্রচেষ্টা ও সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

Recommended Post

আইন ও আইনের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ যাত্রা

আইন ও আইনের ইতিহাসকে বুঝতে হলে এই প্রবন্ধটি অত্যন্ত সহায়ক হবে। এটি প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত আইন প্রণয়নের বিবর্তন এবং এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে স্পষ্ট করে। যারা আইন নিয়ে পড়াশোনা করছেন বা আগ্রহী, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স।

Read More

Recommended Post

ভারতের বিবাহ বিচ্ছেদ আইন সমূহ: আধুনিকীকরণ না নতুন আইনি ব্যবস্থা?

বর্তমানে ভারতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতা কি আধুনিকীকরণের প্রভাব, না কি নতুন আইনি ব্যবস্থার ফলাফল? এই প্রবন্ধটি বিশ্লেষণ করে কেন বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে, আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে এর কারণ এবং এর সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

Read More
anti male laws in India

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top