ভারতে মেডিকেল অবহেলা স্ক্যাম
ভারতে মেডিকেল অবহেলা (negligence) স্ক্যাম খুবই সাধারণ এবং এটি প্রায়শই ভারতীয়দের মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। চিকিৎসা পেশাকে একটি মহৎ পেশা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং প্রায়ই একে ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’ও বলা হয়। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আজকের দিনে চিকিৎসা পেশা একটি কর্পোরেট ব্যবসায় (corporate business) পরিণত হয়েছে। দেশের সর্বত্র চিকিৎসা কেলেঙ্কারি (scandals) ঘটছে এবং সাধারণ মানুষ এর শিকার হচ্ছে। ধনী, গরিব, সবাই ডাক্তার, হাসপাতাল এবং চিকিৎসা সেক্টর এর ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। আপনার পরিচয় বা সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে ডাক্তারের পরামর্শই একমাত্র বিকল্প থাকে।
এটা শুধু ডাক্তারদের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাইভেট হাসপাতাল, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং পুরো চিকিৎসা সেক্টর কর্পোরেট ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনা করা হলো:
KUNAL SAHA V/S DR.SUKANTO MUKHERJEE AND OTHERS. 2011/কুণাল সাহা বনাম ডাঃ সুকান্ত মুখার্জী এবং অন্যরা। 2011
ডাঃ কুনাল সাহা একজন আমেরিকান-ভারতীয় চিকিত্সক যিনি ডাঃ সুকান্ত মুখার্জি এবং কলকাতা ভিত্তিক হাসপাতাল এএমআরআই (AMRI: Advanced Medical Research Institute) এর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তার স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য। তিনি অভিযোগ করেন, ভুল চিকিৎসা (medical malpractice) এবং অবহেলার (negligence) কারণে তার স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। কুনাল সাহা অভিযোগ করেন, রোগীর অনুমতি ছাড়াই উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়েছিল, যা মৃত্যুর কারণ হয়। এই মামলাটি ভারতের চিকিৎসা পেশায় অবহেলা এবং নিয়মিতির অভাবকে সামনে নিয়ে আসে।
Dr. Arvind Shah বনাম Kamlaben Kushwaha (2010)
এই মামলায়, আদালত ডাঃ অরবিন্দ শাহকে চিকিৎসা অবহেলার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে, কারণ তিনি অপারেশন-পরবর্তী সঠিক যত্ন (post-operative care) প্রদান করতে ব্যর্থ হন, যার ফলে রোগীর মৃত্যু ঘটে। আদালত এই ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে এবং জানায় যে, চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর অবহিত সম্মতি (informed consent) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালত আরও উল্লেখ করে যে, চিকিৎসা প্রদানকারীদের দায়িত্ব রয়েছে রোগী এবং তাদের পরিবারকে সম্পূর্ণরূপে সব ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির ঝুঁকি এবং সুবিধা সম্পর্কে অবগত করা। এর ফলে রোগী এবং তাদের পরিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকতে পারে এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে।
DEAD KEPT ALIVE/মৃত শরীরকে জীবিত রাখা
কিছু বেসরকারি হাসপাতালে, মৃতদেহকে জীবিত দাবি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি ঘটনা।
লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি জালিয়াতি
২০২৩ সালের বীমা জালিয়াতি (insurance fraud) সমীক্ষা ইঙ্গিত দেয় যে ভারতে জীবন এবং স্বাস্থ্য বীমার ক্ষেত্রে জালিয়াতি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার, মহামারীর পর থেকে দূরবর্তী কাজের (remote work) চর্চা এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এই জালিয়াতিতে অবদান রেখেছে। নিচে কিছু সাধারণ বীমা জালিয়াতি ধরণ উল্লেখ করা হলো:
- Application fraud (আবেদন জালিয়াতি)
- Claims fraud (জালিয়াতি দাবি)
- Forgery (জালিয়াতি)
- Identity theft (পরিচয় চুরি)
অঙ্গ পাচার
একটি বিস্তৃত তদন্তে দেখা গেছে, প্রতি বছর ভারতে প্রায় ২,০০০ ব্যক্তি কিডনি বিক্রির সাথে জড়িত। প্রতি বছর হাজার হাজার রোগী প্রতারণামূলকভাবে তাদের শরীরের অঙ্গ হারান।
হাসপাতালে রেফারাল কমিশন
সাম্প্রতিক এক তদন্তে দেখা গেছে, সারা দেশের ৫০% ডাক্তার, হাসপাতাল, ফার্মেসি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার রেফারাল কমিশন (referral commission) নিয়ে থাকে। কিছু অসাধু ব্যক্তি এবং কোম্পানি পুরো চিকিৎসা সেক্টরকে একটি কর্পোরেট ব্যবসায় পরিণত করেছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ ফালতু মেডিকেল টেস্ট এবং নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগীদের অধিকার সম্পর্কিত আইন
ভারতে চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন রয়েছে, যা নিম্নরূপ:
Indian Medical Council (Professional Conduct, Etiquette, and Ethics) Regulations, 2002:
এই প্রবিধানগুলি ভারতের চিকিত্সক অনুশীলনকারীদের জন্য চিকিৎসা নৈতিকতা এবং আচরণের (ethics and conduct) কোড নির্ধারণ করে। এগুলি ডাক্তারদের কীভাবে পেশাগতভাবে আচরণ করা উচিত এবং রোগীর সম্মতি নিশ্চিত করা উচিত তা নির্দেশ করে।Consumer Protection Act, 2019:
এই আইনটি ভোক্তাদের (consumers) স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের (healthcare providers) দ্বারা চিকিৎসা অবহেলা এবং অনৈতিক অনুশীলনের জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়ার আইনি কাঠামো প্রদান করে।Clinical Establishment (Registration and Regulation) Act, 2010:
এই আইনটি ক্লিনিকাল প্রতিষ্ঠানগুলিকে (clinical establishments) নিয়ন্ত্রণ করে যাতে তারা ভালো মানের সেবা প্রদান করে এবং নৈতিক মান (ethical standards) বজায় রাখে।Drugs and Cosmetics Act, 1994:
এই আইনটি ভারতে ওষুধ এবং প্রসাধনীর উৎপাদন, বিক্রয় এবং বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে নিম্নমানের পণ্য (substandard products) রোগীদের ক্ষতি করতে না পারে।Transplantation of Human Organs and Tissue Act, 1994:
এই আইনটি মানব অঙ্গ এবং টিস্যুর (organs and tissues) অপসারণ, সংরক্ষণ এবং প্রতিস্থাপন নিয়ন্ত্রণ করে।Indian Penal Code (IPC):
ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি) এর বিভিন্ন ধারা, যেমন 304A (BNS 107), 337 (BNS 125b), এবং 304, চিকিৎসা অবহেলার (medical negligence) সাথে সম্পর্কিত ক্রিমিনাল অপরাধ মোকাবিলায় প্রযোজ্য।
ভারতে মেডিকেল অবহেলা এবং কেলেঙ্কারির ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও কিছু সৎ ডাক্তার, ভালো হাসপাতাল এবং এনজিও রয়েছে যারা রোগীদের সাহায্য করে, তবুও সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আমাদের সরকারের উচিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া।
Recommended Post
ভারতের বিবাহ বিচ্ছেদ আইন সমূহ: আধুনিকীকরণ না কি আইনি ব্যবস্থার পরিবর্তন?
বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রকৃত কারণগুলো অন্বেষণ করুন এই প্রবন্ধে। আধুনিকীকরণের প্রভাব নাকি নতুন আইনসমূহের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে, তা জানার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Reference- THE BHARATIYA NYAYA SANHITA, 2023 THE INDIAN PENAL CODE, 1860 indiankanoon.org lawdocs.in www2.deloitte.com theprobe.in Indian Medical Council (professional Conduct, Etiquette And Ethics) Regulations, 2002 Consumer Protection Act, 2019 THE CLINICAL ESTABLISHMENTS (REGISTRATION AND REGULATION) ACT, 2010 THE DRUGS AND COSMETICS ACT, 1940 THE TRANSPLANTATION OF HUMAN ORGANS AND TISSUES ACT, 1994