ভারতে ধর্ষণ এখনও দেশের অন্যতম গুরুতর মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। কঠোর আইনি সংস্কার (legal reforms) এবং ক্রমবর্ধমান জনসচেতনতা সত্ত্বেও, ধর্ষণের ঘটনা কমছে না, যা দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত হতবাক করে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৩১,৫১৬টি ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি। আন্তর্জাতিকভাবে, নারীদের সুরক্ষা নিয়ে ভারত তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে।
এই প্রবন্ধে আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখবো: ধর্ষণের ঘটনা সত্যিই বাড়ছে, নাকি আগে সেগুলো রিপোর্ট (reported) করা হতো না? এবং আরও শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও কেন ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না? শুধুমাত্র পরিসংখ্যানের (statistics) বাইরে গিয়ে, আমরা সেই সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সিস্টেমেটিক (systemic) ব্যর্থতাগুলো বিশ্লেষণ করবো যা এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে।
ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে নাকি আগে রিপোর্ট করা হতো না?
দশকের পর দশক ধরে ভারতে ধর্ষণের ঘটনা খুবই কম রিপোর্ট করা হতো। সমাজের প্রচলিত লজ্জা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ভয় এবং পিতৃতান্ত্রিক (patriarchal) মূল্যবোধের কারণে ভুক্তভোগীরা (victims) অভিযোগ করতে ভয় পেতেন। ২০১২ সালে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া নির্মম নির্ভয়া গণধর্ষণ কেসটি (Nirbhaya gang rape case) একটি মোড় ঘুরিয়েছিল, যা জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি রিপোর্টিং সিস্টেমের (reporting system) উন্নতি ঘটায়। ২০১৩ সাল থেকে NCRB ক্রমাগত ধর্ষণ মামলার সংখ্যা বাড়তে দেখেছে, যদিও কোভিড-১৯ মহামারির সময় কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। এই বৃদ্ধি শুধুমাত্র ঘটনার সংখ্যা বাড়ার ইঙ্গিত দেয় না, বরং অপরাধের রিপোর্ট করার প্রবণতা বাড়ার প্রতিফলনও হতে পারে।
তবুও, ভারতের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে গভীরভাবে প্রোথিত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো যৌন সহিংসতার রিপোর্টিংকে প্রতিহত করে যাচ্ছে। প্রতিশোধের ভয়, লজ্জা এবং আইনি ব্যবস্থার (legal system) অভাবের কারণে অনেক ভুক্তভোগী এখনো চুপ করে থাকেন।
উল্লেখযোগ্য ধর্ষণ মামলাগুলি: সংকটের একটি চিত্র
ভারতে অনেক উচ্চ-প্রোফাইল (high-profile) ধর্ষণ মামলা জনসাধারণকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং সরকারের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার উদাহরণ দেওয়া হলো, যা সমস্যার গুরুতরতা প্রদর্শন করে:
- নির্ভয়া কেস (২০১২): দিল্লিতে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণীর নির্মম গণধর্ষণ বিশ্বব্যাপী নিন্দার জন্ম দেয় এবং ২০১৩ সালের ক্রিমিনাল ল (সংশোধনী) আইন (Criminal Law (Amendment) Act) প্রণীত হয়, যা যৌন সহিংসতার (sexual violence) জন্য আরও কঠোর শাস্তির বিধান করে।
- শক্তি মিলস গণধর্ষণ (২০১৩): মুম্বাইয়ে দুজন নারী, যার মধ্যে একজন সাংবাদিকও ছিলেন, গণধর্ষণের শিকার হন। অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
- হায়দরাবাদ পশুচিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যা (২০১৯): একজন তরুণ পশুচিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়, এবং পরে অভিযুক্ত চারজনকে পুলিশের এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়, যা আইনের শাসন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
- হাথরাস কেস (২০২০): উত্তরপ্রদেশে একজন দলিত (Dalit) নারীকে গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা জাতীয় স্তরে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে জাতিভিত্তিক সহিংসতা এবং কেসটির ভুল পরিচালনা নিয়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে।
- উন্নাও কেস (২০১৭): কুলদীপ সিং সেঙ্গার নামক এক রাজনীতিবিদ একজন নাবালিকাকে ধর্ষণ করেন এবং পরে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড (life imprisonment) দেওয়া হয়।
এই ঘটনাগুলি মিডিয়ার মনোযোগ পেয়েছিল এবং জনগণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তবে হাজার হাজার কম-প্রচারিত কেস অদৃশ্য থেকে যায়, যা ন্যায়বিচারের (justice) প্রচুর ফাঁক তুলে ধরে।
ধর্ষণের শিকারদের (victim) জন্য ন্যায়বিচার: পরিসংখ্যানের বাস্তবতা
আইনি সংস্কার (legal reforms) এবং দ্রুত বিচার আদালত (fast-track courts) প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও ধর্ষণের শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার প্রায়ই অধরাই থেকে যায়। NCRB-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৭-৩০% ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত (conviction) হয়, যার মানে প্রতি চারজন অভিযুক্তের মধ্যে তিনজন মুক্তি পায়। কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছে:
- বানতলা ধর্ষণ কেস (১৯৯০): ন্যায়বিচার পেতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়, অভিযুক্তদের আজীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয় অনেক বিলম্বের পরে।
- কন্ধমল কেস (২০১৫): একটি নাবালিকার ধর্ষণ মামলা বছরের পর বছর ধরে আদালতে আটকে আছে এবং এখনো চূড়ান্ত রায় হয়নি।
- আর.জি. কর মেডিকেল কলেজ কেস (২০২৪): কলকাতার আর.জি. কর মেডিকেল কলেজের একটি উচ্চ প্রোফাইল ধর্ষণ মামলা, যেখানে একজন জুনিয়র ডাক্তার ক্যাম্পাসেই ধর্ষণের শিকার হন। এই মামলাটি প্রাথমিক তদন্তে ধীরগতি এবং প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে আলোচনায় আসে। অভিযোগ করার পর পুলিশ যথাযথভাবে তদন্ত চালাতে বিলম্ব করে এবং অভিযুক্তদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই মামলাটি ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি এবং প্রভাবশালীদের ছাড় পেয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে আবারও সামনে এনেছে।
ভারতের বিচারব্যবস্থায় নারী-সম্পর্কিত অপরাধের ৪,০০,০০০-এরও বেশি মুলতুবি থাকা মামলা ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলেছে। ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবার বছরের পর বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে যান, যা অনেক সময় কয়েক দশক ধরে চলতে থাকে।
কেন ধর্ষণের ভিক্টিম রা ন্যায়বিচার পান না?
ধর্ষণের শিকাররা (ভিক্টিম রা ) ন্যায়বিচার না পাওয়ার পেছনে কয়েকটি সিস্টেমেটিক কারণ রয়েছে:
- দুর্নীতি (corruption): ঘুষ, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং দায়িত্বের অভাব অপরাধীদের, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের, ন্যায়বিচার থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
- পুলিশের উদাসীনতা: পুলিশ প্রায়ই অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব দেয় না বা ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দায়ের করতে নিরুৎসাহিত করে। অনেক ক্ষেত্রে, ভুক্তভোগীরা সংবেদনশীল প্রশ্নের সম্মুখীন হন, যা তাদের আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ থেকে দূরে রাখে।
- ভিকটিম-ব্লেমিং (victim-blaming): সামাজিক নিয়ম প্রায়ই অপরাধীদের পরিবর্তে ভুক্তভোগীদের দোষারোপ করে, তাদের পোশাক, জীবনধারা, বা ঘটনার পরিস্থিতির জন্য তাদের দায়ী করে।
এই সব কারণ দেখায় যে, আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন দুর্বল এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি রয়েছে।
দুর্নীতি: ধর্ষণ বন্ধ না হওয়ার মূল কারণ
ধর্ষণ না কমার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো দুর্নীতি (corruption), যা সমাজের প্রতিটি স্তরে গভীরভাবে প্রোথিত।
- পুলিশ বিভাগের দুর্নীতি: ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করার পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে নেন না। অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হলে ঘুষ দিয়ে নিজেদের রক্ষা করে। ফলে অনেক ধর্ষণ মামলা তদন্তের পর্যায়েই আটকে থাকে।
- রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি: ক্ষমতাশালী অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বা ঘুষের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করে ফেলে। এর ফলে বিচারপ্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়।
সামাজিক মানসিকতা এবং পিতৃতান্ত্রিক ধাঁচ
আইনের দুর্বল বাস্তবায়নের পাশাপাশি, ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে প্রায়শই ব্যর্থ। অনেক সময় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের সমাজের দৃষ্টিতে খারাপভাবে দেখা হয়। অনেক গ্রামীণ এলাকায়, ধর্ষণের শিকার নারীকে দোষারোপ করা হয়, আর ধর্ষকদের সহানুভূতি দেখানো হয়।
আইন এবং বাস্তবায়ন: দুটি ভিন্ন জিনিস
ভারতে ধর্ষণ প্রতিরোধে শক্তিশালী আইন (laws) থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন (implementation) হয় না। পুলিশের উদাসীনতা এবং বিচারব্যবস্থার ধীরগতি আইনের কার্যকারিতা নষ্ট করে।
পরিবর্তনের দায়িত্ব: নাগরিকদের ভূমিকা
আইন এবং বিচারব্যবস্থা ছাড়াও, ধর্ষণ প্রতিরোধে সমাজের প্রতিটি স্তরে পরিবর্তনের প্রয়োজন। নাগরিকদের সৎ নেতাদের নির্বাচন করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং ধর্ষণ শিকারদের সমর্থন জানানো উচিত।
ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনকে আরও কঠোর করতে হবে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের মনোভাবও পরিবর্তন করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করে, ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করে এবং ধর্ষণের শিকারদের (ভিক্টিমদের) সম্মান দিয়ে আমরা এই সমস্যার সমাধানে একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে পারি।
Recommended Post
পুরুষকে ধর্ষণ সম্ভব? পুরুষ ধর্ষণ আইন ও তার গুরুত্ব
পুরুষ ধর্ষণের বাস্তবতা এবং আইনি দিক সম্পর্কে জানুন। এই প্রবন্ধটি আলোচনা করে পুরুষের জন্য ধর্ষণ আইনের প্রয়োজনীয়তা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব।
Recommended Post
মেডিকেল স্ক্যামের ভয়াবহতা: Kunal Saha vs. Dr. Sukanto Mukherjee and Others (2011)
ভারতের মেডিকেল স্ক্যামগুলির ভয়াবহতা এবং Kunal Saha বনাম Dr. Sukanto Mukherjee মামলার বিশদ বিশ্লেষণ। এই মামলাটি ভারতের স্বাস্থ্যসেবায় বড় একটি কেলেঙ্কারি প্রকাশ করেছে। এটি জানার জন্য পড়ুন কীভাবে চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলি রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে।
Reference- National Crime Records Bureau www.deccanherald.com 2012 Delhi gang rape and murder The Criminal Law (Amendment Act), 2013 Shakti Mills gang rape 2019 Hyderabad gang rape and murder The Hathras Gang Rape The 2017 Unnao Rape case 2024 Kolkata rape and murder 1990 Bantala rape case 2015 Kandhamal gang rape case The Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012 Deccanherald.Com