
ভূমিকা
ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যময় সামাজিক কাঠামো বিবাহকে সাধারণত জীবনের একটি আজীবন প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখে। কিন্তু, ক্রমবর্ধমান বিবাহবিচ্ছেদের হার সমাজের গতিশীলতায় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই নিবন্ধে আমরা এই প্রবণতার পেছনের কারণগুলো এবং ভারতের বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কিত আইনি বিধানগুলো বিশদভাবে আলোচনা করব।
পরিবর্তিত সামাজিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি
বিবাহের ধারণার পরিবর্তন:
আগে, ভারতে বিবাহ সাধারণত পরিবার দ্বারা নির্ধারিত হতো, যেখানে দুটি পরিবার একসঙ্গে আসত এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের আশা করত। কিন্তু বর্তমান সমাজে মানুষ তাদের বিবাহের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুখ, মানসিক পূর্ণতা, এবং সঙ্গীর সাথে মানসিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন অনেকেই মনে করেন যে যদি সম্পর্কটি তাদের মানসিক শান্তি বা সুখকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
আইনি দিক:
ভারতের হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ (Hindu Marriage Act, 1955) অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু কারণে বিবাহবিচ্ছেদ করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো নিষ্ঠুরতা (cruelty), যেখানে এক সঙ্গী অন্য সঙ্গীর প্রতি শারীরিক বা মানসিকভাবে অত্যাচার করে; পরিত্যাগ (desertion), যেখানে এক সঙ্গী অন্য সঙ্গীকে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই ছেড়ে চলে যায়; এবং পারস্পরিক সম্মতি (mutual consent), যেখানে উভয় পক্ষ একমত হয় যে তারা আর একসঙ্গে থাকতে চায় না এবং বিবাহবিচ্ছেদ করতে চায়।
নারীর ক্ষমতায়ন
শিক্ষা এবং কাজের সুযোগ:
বর্তমান সমাজে নারীরা এখন আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং কর্মজীবী। তাদের আর্থিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে তারা নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে এবং নিজের জীবনে কী চায় তা নির্ধারণ করতে পারছে। ফলে, তারা আর অসুখী বা অবমাননাকর সম্পর্ক মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে না।
আইনি সমর্থন:
হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ এর অধীনে ধারা ১৩বি (Section 13B) নারীদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ দেয়। এখানে উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদ করা যেতে পারে, যা নারীদের জন্য একটি সুবিধাজনক উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (Shariat) এবং মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ এর অধীনে, মুসলিম নারীরা বিশেষ কিছু কারণে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন, যেমন স্বামীর দ্বারা অবহেলা, নিষ্ঠুরতা, বা আর্থিক সহায়তা না দেওয়া।
নারীর স্বাধীনতার প্রভাব
ইতিবাচক দিক:
নারীর স্বাধীনতার ফলে সমাজে কয়েকটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এখন নারীরা আরও সমান অধিকার এবং সুযোগ পাচ্ছে, যা তাদেরকে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। সমাজও ধীরে ধীরে নারীদের এই নতুন ভূমিকা মেনে নিচ্ছে। নারীদের ক্ষমতায়নের ফলে তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশি অংশগ্রহণ করছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে। এছাড়াও, পরিবার পরিকল্পনা এবং গর্ভধারণের উপর নারীদের অধিক নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে জন্মহারের হ্রাস দেখা যাচ্ছে।
নেতিবাচক দিক:
নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সমাজের কিছু অংশে প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, যারা ঐতিহ্যগত মূল্যবোধে বিশ্বাসী, তারা নারীদের নতুন ভূমিকা মেনে নিতে কষ্ট পাচ্ছে, যা সমাজে সংঘাতের সৃষ্টি করছে। এছাড়াও, নারীদের পরিবর্তিত ভূমিকার কারণে পরিবারের কাঠামো পরিবর্তিত হচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভারসাম্যও পরিবর্তিত হচ্ছে, যা পরিবারে চাপ বাড়াচ্ছে। প্রজন্মের মধ্যে মতপার্থক্য এবং নতুন মূল্যবোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে।
অর্থনৈতিক কারণ
আর্থিক স্বাধীনতা:
নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা তাদের বিবাহে স্বাধীনতা দিয়েছে। আগে নারীরা তাদের স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু এখন তারা আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়ায়, অসুখী বা অবমাননাকর সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে।
আইনি সুরক্ষা:
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৭৩ (Criminal Procedure Code, 1973) এর অধীনে ধারা ১২৫ (Section 125) (Section 144 of BNSS) অনুযায়ী, স্বামীর দ্বারা স্ত্রীর জন্য ভরণপোষণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর ফলে, বিবাহবিচ্ছেদ হলেও স্ত্রী আর্থিকভাবে সুরক্ষিত থাকে।
নগরায়ণ এবং আধুনিক জীবনযাপন
আধুনিক জীবনের প্রভাব:
নগরায়ণ এবং আধুনিক জীবনের চাপে বিবাহিত জীবনে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মানুষ এখন শহুরে জীবনের চাহিদা, কাজের চাপ, এবং ব্যক্তিগত জীবনের চাপে বিবাহবিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকছে। নগরায়ণ মানুষকে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও আধুনিক ধারণার সাথে পরিচিত করছে, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণাকে বাড়িয়ে তুলছে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তাভাবনার জন্ম দিচ্ছে।
শিক্ষা ও সচেতনতা
আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা:
শিক্ষিত মানুষ তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে বেশি সচেতন। তারা আর দুঃখজনক বিবাহকে মেনে নিতে ইচ্ছুক নয়। শিক্ষার মাধ্যমে তারা জানতে পারছে তাদের কী কী অধিকার রয়েছে এবং তারা কীভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারে। এই সচেতনতা তাদের বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আরও নিশ্চিত এবং কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে।
আইনি এবং নীতিগত পরিবর্তন
আইনি প্রক্রিয়া সহজতর:
বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। আইন পরিবর্তনের ফলে এখন দম্পতিরা সহজেই বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারছে।
প্রাসঙ্গিক আইন:
ফ্যামিলি কোর্টস অ্যাক্ট, ১৯৮৪ (Family Courts Act, 1984) অনুযায়ী, পরিবারের সমস্যা সমাধানের জন্য আদালত স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে বিবাহবিচ্ছেদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই আইনগুলো বিবাহবিচ্ছেদকে সহজতর করে তুলেছে এবং মানুষকে তাদের দাম্পত্য জীবনে যদি সমস্যা হয়, তাহলে আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
আধুনিক জীবনের চাপ
কাজের চাপ:
আধুনিক জীবনের চাপে মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছে, যার ফলে দাম্পত্য জীবনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা, ট্রাফিক জ্যামে সময় নষ্ট করা এবং অর্থনৈতিক চাপের কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়ছে।
সামাজিক কলঙ্কের হ্রাস
বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্যতা:
আগে বিবাহবিচ্ছেদকে সমাজে নেতিবাচকভাবে দেখা হতো, কিন্তু বর্তমানে সমাজ বিবাহবিচ্ছেদকে একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে মেনে নিচ্ছে। মানুষ এখন অসুখী সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে বিবাহবিচ্ছেদকে একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে, যা তাদের জীবনে নতুন সূচনা করতে সাহায্য করছে।
দেরিতে বিবাহ
উচ্চ প্রত্যাশা:
মানুষ এখন আগের তুলনায় দেরিতে বিয়ে করছে, যার ফলে তাদের জীবনের লক্ষ্য এবং প্রত্যাশা সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা থাকে। দেরিতে বিয়ে করার ফলে মানুষ আরও সচেতনভাবে এবং চিন্তাভাবনা করে সঙ্গী নির্বাচন করছে, যা তাদের বিবাহে উচ্চ প্রত্যাশা তৈরি করছে এবং বিবাহবিচ্ছেদের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলছে।
উপসংহার
ভারতে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধির পেছনে পরিবর্তিত সামাজিক চিন্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, নগরায়ণ, শিক্ষা ও আইনি পরিবর্তনের একটি জটিল সংযোগ রয়েছে। এই কারণগুলো বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলোর মাধ্যমে আমরা আধুনিক দাম্পত্য জীবনের জটিলতাগুলো মোকাবিলা করতে পারব। আধুনিক মূল্যবোধের সাথে ঐতিহ্যগত নীতিগুলোর সমন্বয় করে দাম্পত্য সম্পর্ককে শক্তিশালী করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের হার কমানো যেতে পারে।
ভারতে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রধান আইনি বিধান
হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ (Hindu Marriage Act, 1955)
- ধারা ১৩ (Section 13): নির্দিষ্ট কিছু কারণে, যেমন নিষ্ঠুরতা (cruelty), পরিত্যাগ (desertion), এবং ধর্মান্তরিত হওয়া (conversion) এর ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদের বিধান রয়েছে।
- ধারা ১৩বি (Section 13B): পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ (Divorce by mutual consent) করার সুযোগ দেয়।
মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন, ১৯৩৭ (Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937)
- মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কিত নিয়মাবলী নিয়ন্ত্রণ করে।
মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ (Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939)
- মুসলিম নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কারণে বিবাহবিচ্ছেদের সুযোগ দেয়, যেমন স্বামীর দ্বারা অবহেলা (non-maintenance) এবং নিষ্ঠুরতা (cruelty)।
ফৌজদারি কার্যবিধি (Criminal Procedure Code), ১৯৭৩
- ধারা ১২৫ (Section 125)(Now Section 144 of BNSS): স্বামী দ্বারা স্ত্রীর জন্য ভরণপোষণ (maintenance) প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৯৫৪ (Special Marriage Act, 1954)
- নাগরিক বিবাহ এবং হিন্দু বিবাহ আইনের অনুরূপ ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদের নিয়ম করে।
ফ্যামিলি কোর্টস অ্যাক্ট, ১৯৮৪ (Family Courts Act, 1984)
- পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য ফ্যামিলি কোর্ট স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই আইনি বিধানগুলো বোঝা এবং সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন যাতে মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত হয় এবং অসুখী বিবাহ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
Recommended Post
নারী সুরক্ষা আইন, না কি পুরুষবিরোধী আইন? ভারতে আইনগুলির অপব্যবহার ও এর ফলাফল
ভারতে নারী সুরক্ষার জন্য আইন প্রণীত হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এই আইনগুলির অপব্যবহার পুরুষদের উপর ভুল প্রভাব ফেলে। এই প্রবন্ধটি আলোচ্য বিষয়ের বিশদ বিশ্লেষণ প্রদান করে, যেখানে দেখা যাবে কীভাবে আইনের অপব্যবহার সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
Recommended Post
আইন ও আইনের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ যাত্রা
আইন ও তার ইতিহাসের বিবর্তন জানুন - প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত। এই প্রবন্ধটি আইনশাস্ত্রের ছাত্র এবং আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য একটি সমৃদ্ধ রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে, যেখানে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট থেকে আইন কীভাবে বিকশিত হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
Recommended Post
ভারতের নারীর অধিকার: আইনি মাইলস্টোন এবং প্রগতির ধারা
ভারতের নারীদের অধিকারের যাত্রাপথে গুরুত্বপূর্ণ আইনি মাইলস্টোন এবং প্রগতির ধারা সম্পর্কে জানতে এই প্রবন্ধটি পড়ুন। এটি নারী অধিকারের জন্য প্রণীত আইনি পরিবর্তন ও উদ্যোগগুলির বিবর্তন এবং এর ফলাফলকে তুলে ধরেছে, যা সমাজে নারীর অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।